শিবপুরাণের বায়বীয় সংহিতার উত্তরভাগে মহর্ষি উপমন্যু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে মহেশ্বর শিবের অষ্টমূর্তির কথা বর্ণনা করেন। মহর্ষি উপমন্যু বলেন,
পরমাত্মা রূপ শিব সকল এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া সর্বত্র আছেন, তাই তাঁর নাম ‘সর্ব’। সর্বভূতের অণুতে পরমাণুতে তিনি বিরাজমান। তিনিই নিষ্ক্রিয় ব্রহ্ম, আবার তিনিই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, মহেশ্বর ও সদাশিব। তিনিই সৃষ্টি করেন, তিনিই পালন করেন এবং তিনিই লয় করেন।
স শিবঃ সর্বমেবেদং স্বকীয়াভিশ্চ মূর্তিভিঃ
অধিতিষ্ঠত্যমেয়াত্মা যৎ তৎ সর্বস্ততঃ স্মৃতঃ।।
ব্রহ্মা বিষ্ণুস্তথা রুদ্রো মহেশানঃ সদাশিবঃ।
মূর্তয়স্তস্য বিজ্ঞেয়া যাভির্বিশ্বমিদং ততম্।।
(শিবপুরাণ: বায়বীয়সংহিতা, উত্তরভাগ,৪.২-৩)
“পরমাত্মা শিব স্বকীয় মূর্ত্তিসমূহ দ্বারা সকল কিছুতেই অধিষ্ঠান করে আছেন বলে তিনি ‘সর্ব’ নামে কীৰ্ত্তিত। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, মহেশ্বর ও সদাশিবসহ বিবিধ মূর্তিতে প্রকাশিত।”
ভগবান শিবকে পঞ্চানন বলা হয়। কারণ তিনি ব্ৰহ্মরূপ পঞ্চমূর্তিতে জগতে বিরাজমান। জগতের সকল সকল কিছুই এ পঞ্চমূর্তিতে ব্যাপ্ত। সর্বত্র ব্যাপ্ত এ ব্রহ্মের পঞ্চমূৰ্ত্তি হল-ঈশান, তৎপুরুষ, অঘোর, বামদেব, সদ্যোজাত।
ঈশানঃ পুকুষােঽঘোরাে বামঃ সদ্যস্তথৈব চ। ব্ৰহ্মাণ্যেতানি দেবস্য মূর্তয়ঃ পঞ্চ বিশ্রুতাঃ॥
(শিবপুরাণ: বায়বীয়সংহিতা, উত্তরভাগ,৪.৫)
১.ঈশান:
ঈশানাখ্যা তু যা তস্য মূর্তিরাদ্যা গরীয়সী।
ভোক্তারং প্রকৃতেঃ সাক্ষাৎ ক্ষেত্রজ্ঞমধিতিষ্ঠতি॥
(বায়বীয়সংহিতা, উত্তরভাগ,৪.৬)
ঈশান নামের শ্রেষ্ঠ মূর্তি, সাক্ষাৎ প্রকৃতি ভােক্তা। ক্ষেত্রজ্ঞ পুরুষরূপে সেই মূর্তিতে তিনি অধিষ্ঠান করছেন। পণ্ডিতেরা ঈশ্বরের ঈশানাখ্যা মূর্তিকে শ্রােত্র, বাক, শব্দ, বিভু ও ব্যোমের আধার বলে জানেন।
২.তৎপুরুষ:
স্থাণােস্তৎ পুরুষাখ্যা যা মূর্তিমূর্তিমতঃ প্রভােঃ। শুণাশ্রয়াত্মকং ভােগ্যমব্যক্তমধিতিষ্ঠতি ॥
(বায়বীয়সংহিতা, উত্তরভাগ,৪.৭)
মূর্তিমান প্রভু গিরিশের তৎপুরুষ নামে দ্বিতীয় মূর্তি সত্ত্বাদি গুণকে আশ্রয় করে প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হয়ে ভোগ করছেন। তৎপুরুষ নামক পরমেশ্বরের মূর্তি ত্বক, পাণি, স্পর্শ ও বায়ুর আধার।
৩.অঘোর:
ধর্মাদ্যষ্টাঙ্গসংযুক্তং বুদ্ধিতত্বং পিনাকিনঃ।
অধিতিষ্ঠ্যতে ঘোরাখ্যা মূর্তিরত্যন্তপূজিতা॥
(বায়বীয়সংহিতা, উত্তরভাগ,৪.৮)
পিনাকপাণি মহেশ্বরের অত্যন্ত পূজনীয় অঘোর নামক তৃতীয় মূর্তি ধৰ্ম্মাদি অষ্টাঙ্গ সংযুক্ত বুদ্ধিতত্ত্বে অবস্থান করছেন। পরমেশ্বরের অঘাের মূর্তি চক্ষু, চরণ, রূপ ও অগ্নির আধার।
৪. বামদেব:
বামদেবাহবয়া মূর্তির্মহাদেবস্য বেধসঃ। অহঙ্কৃতেরধিষ্ঠাত্রীমাহুরাগমবেদিনঃ ॥
(বায়বীয়সংহিতা, উত্তরভাগ,৪.৯)
শাস্ত্রজ্ঞ বুদ্ধিমানেরা অমিততেজা মহাদেবের বামদেব নামক চতুর্থ মূর্তিকে অহংকারে অধিষ্ঠাত্রী বলে জানেন।বামদেবাখ্য মূর্তি হল জিহবা, পায়ু, রস ও জলের ঈশ্বরী।
৫.সদ্যোজাত:
সদ্যোজাতাহবয়াং মূর্তিং শম্ভোরমিতবর্চসঃ।
মনসঃ সমধিষ্ঠাত্রীং মতিমন্তঃ প্রচক্ষতে ॥
(বায়বীয়সংহিতা, উত্তরভাগ,৪.১০)
পরমেশ্বর শিবের সদ্যোজাত নামে পঞ্চম মূর্তিকে মনের অধিষ্ঠাত্রী বলা হয় ।তিনি ঘ্রাণ, গন্ধ পৃথিবী ও উপস্থের ঈশ্বরী।
Also Read: Saraswati Puja 2025
পরমেশ্বর শিবের এ পঞ্চরূপ জীবের কল্যাণের আধার। মুক্তিপ্রত্যাশী সকল জীবকেই কল্যাণের আধার শিবের পথে অত্যন্ত প্রযত্নের সাথে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। শিবের কল্যাণময় পঞ্চমূর্তির সাথেই আছে অষ্টমূর্তি সহ অনন্ত মূর্তিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বিরাজমান। জগতের এমন কোন স্থান নেই, যে স্থানে শিব নেই। এ জগত শিবময়। শিবের স্পন্দনেই জগত স্পন্দিত। তিনিই সৃষ্টি করেন, তিনিই লয় করেন।সেই দেবাদিবের অষ্টমূর্ত্তিময় এই নিখিল জগৎ সেই অষ্টমূর্ত্তিতে, সূত্রে মণিগণের ন্যায় ব্যাপিয়া আছেন।
শর্ব্বো ভবস্তথা রুদ্র উগ্রো ভীমঃ পশোঃপতিঃ।
ঈশানশ্চ মহাদেবো মূর্ত্যয়শ্চাষ্ট বিশ্রুতাঃ।।
(বায়বীয়সংহিতা, উত্তরভাগ,৪.১৮)
“সেই সকল অষ্টসংখ্যক মূর্ত্তি শর্ব্ব, ভব, রুদ্র, উগ্র, ভীম, পশুপতি, ঈশান ও মহাদেব এই আট নামে প্রসিদ্ধ।”
১.শর্ব:
চরাচরাত্মকং বিশ্বং ধত্তে বিশ্বম্ভরাত্মিকা।
শার্বী শর্ববাহ্বয়া মূর্তিরিতি শাস্ত্রস্য নিশ্চয়ঃ।।
(বায়বীয়সংহিতা, উত্তরভাগ,৪.২০)
ইহা শাস্ত্রনিশ্চয় যে , পরমাত্মা শর্ব্বের পৃথিবী-রূপিণী ‘শর্ব’ নামে মূর্ত্তি স্থাবর-জঙ্গমাত্মক বিশ্বকে ধারণ করিতেছেন।
২.ভব:
সঞ্জীবনং সমস্তস্য জগতঃ সলিলাত্মকম্।
ভব ইত্যুচ্যতে মূর্তির্ভবস্য পরমাত্মনঃ॥
(বায়বীয়সংহিতা, উত্তরভাগ,৪.২১)
জল-রূপিণী ‘ভব’ নামের দ্বিতীয় মূর্ত্তি সমস্ত জগতের জীবন রক্ষা করিতেছেন।
৩. রুদ্র:
বহিরন্তর্জগদ্বিশ্বং ব্যাপ্য তেজোময়ী শুভা।
রৌদ্রী রুদ্রাহবয়া মূর্তিরাস্থিতা ঘোররূপিণী॥
(বায়বীয়সংহিতা, উত্তরভাগ,৪.২২)
রুদ্রের অঘোর-রূপিণী শুভজনিকা তেজোময়ী রুদ্রাখ্যা মূর্ত্তি জগতের বাহিরে ও অন্তরে ব্যাপিয়া অধিষ্ঠান করিতেছেন।
৪.উগ্র:
স্পন্দন পবনো বিশ্বং বিভর্তি স্পন্দতে স্বয়ম্।
উগ্র ইত্যুচ্যতে সদ্ভির্মূর্তিরুগ্রস্য বেধসঃ॥
(বায়বীয়সংহিতা, উত্তরভাগ,৪.২৩)
বেধা উগ্রের পবনাত্মিকা যে মূর্ত্তি এই বিশ্বকে স্পন্দিত করিয়া ধারণ করিতেছেন এবং স্বয়ং স্পন্দিত হইতেছেন, পণ্ডিতেরা সেই মূর্ত্তিকে উগ্র নামে আখ্যায়িত করেন।
৫.ভীম:
সর্বাবকাশদা সর্বব্যাপিকা গগনাত্মিকা।
মূর্তিভীমস্য ভীমাখ্যা ভূতবৃন্দস্য ভেদিকা।।
(বায়বীয়সংহিতা, উত্তরভাগ,৪.২৪)
সকলের অবকাশদায়িনী গগনময়ী ভীমের ভীমাখ্য মূর্ত্তি সকল ভূতের ভেদসাধন করত এই অখিল বিশ্বকে ব্যাপিয়া রহিয়াছেন।
৬.পশুপতি:
সর্বাত্মনামধিষ্ঠাত্রী সর্বক্ষেত্রনিবাসিনাম্।
মূর্তিঃ পশুপতের্জ্ঞয়া পশু-পাশ-নিকৃন্তনী।।
(বায়বীয়সংহিতা, উত্তরভাগ,৪.২৫)
সর্ব্বক্ষেত্র-নিবাসী সর্ব্ব-রূপী ক্ষেত্রজ্ঞের অধিষ্ঠাত্রী পশুপতি নাম্নী ষষ্ঠমূর্ত্তি পশুদিগের পাশবন্ধন ছেদন করিতেছেন।
৭.ঈশান:
দীপয়ন্তী জগৎ সর্বং দিবাকরসমাহ্বয়া।
ঈশানাখ্যা মহেশস্য মূর্তির্দিবি বিসর্পতি।।
(বায়বীয়সংহিতা, উত্তরভাগ,৪.২৬)
নিখিল জগতের দীপ্তিজনিকা দিবাকরস্বরূপা মহেশের ঈশানাখ্য মূর্ত্তি আকাশ ব্যাপিয়া অবস্থান করিতেছেন।
৮. মহাদেব:
আপ্যায়য়তি যাে বিশ্বমমৃতাংশুর্নিশাকরঃ।
মহাদেবস্য সা মূর্তিমহাদেবসমাহ্বয়া ॥
(বায়বীয়সংহিতা, উত্তরভাগ,৪.২৭)
আর শিবের সোমময়ী মহাদেবাখ্য মূর্ত্তি সুধাংশু-বর্ষণে অখিল ভুবনের আনন্দোৎপাদন করিতেছেন।
পরমেশ্বর শিবের শর্ব্বাদি অষ্টমূর্ত্তিই ক্ষিতি, জল, অনল, অনিল, আকাশ, ক্ষেত্রজ্ঞ, সূর্য্য ও চন্দ্রে যথাক্রমে অধিষ্ঠান করছেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ব্যাপী এ অষ্টমূর্তির কারণেই সমগ্র জগত শিবময়।
আত্মনশ্চাষ্টমী মূর্ত্তিঃ শিবস্য পরমাত্মনঃ।
ব্যাপিকেতরমূর্ত্তীনাং বিশ্বং তস্মাচ্ছিবাত্মকম্।
(বায়বীয়সংহিতা, উত্তরভাগ,৪.২৮)
“পরমাত্মা শিবের ঐ অষ্টমূর্তি স্বীয় অপরমূর্ত্তিগুলিকে ব্যাপিয়া আছেন বলিয়া, বিশ্ব শিবাত্মক নামে প্রসিদ্ধ।”
পরমেশ্বর শিবের এ অষ্টমূর্তির বন্দনা মহাকবি কালিদাসও করেছেন। তাঁর জগদ্বিখ্যাত ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ গ্রন্থের শুরুতে নান্দীশ্লোকেই তিনি অষ্টমূর্তিধারী শিবের স্তোত্র করেছেন। তবে কালিদাসের অষ্টমূর্তির বর্ণনায় শিবমহাপুরাণের সাথে সামান্য পার্থক্য পাওয়া যায়। কালিদাস অষ্টমূর্তির নামগুলো সরাসরি বলেন নি। শুধু তাঁদের কর্ম বর্ণনা করেছেন।
যা সৃষ্টিঃ শ্ৰষ্টুরাদ্যা বহতি বিধিহুতং যা হবির্যা চ হােত্রী যে দ্বে কালং বিধত্তঃ শ্রুতিবিষয়গুণা যা স্থিতা ব্যাপ্য বিশ্বম্।
যামাহুঃ সর্ববীজপ্রকৃতিরিতি যয়া প্রাণিনঃ প্রাণবন্তঃ প্রত্যক্ষাভিঃ প্রপন্নস্তনুভিরবতু বস্তাভিরষ্টাভিরীশঃ॥
“যে মূর্তি স্রষ্টা প্রজাপতি ব্রহ্মার অব্যবহিত পূর্বে বর্তমান ছিল ( জল), যে মূর্তি শাস্ত্রবিধানানুসারে প্রদত্ত ঘৃতাদিরূপ হব্য বহন করে (অগ্নি), যে মূৰ্ত্তি হােম সম্পাদন করে (যজমান), যে মূৰ্ত্তিদ্বয় সময় বিধান করে (সূর্য এবং চন্দ্র), কর্ণেন্দ্রিয়গ্রাহ্যগুণ যে মুর্তি সমস্ত বিশ্ব জুড়ে রয়েছে (আকাশ), যে মূর্তিকে সকল বীজের আধার বলা হয় ( পৃথিবী) এবং যে মূর্তির দ্বারা প্রাণিসকল বলসম্পন্ন হয়ে থাকে (বায়ু) – প্রত্যক্ষ এ অষ্টমূর্তিধর সেই শিব জগতের সবাইকে রক্ষা করুন।
মূর্তি অথবা ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এবং ব্যোম এ পঞ্চভূতের যে কোন উপাদানেই ভগবান শিবকে উপাসনা করা যায়। তবে শিব উপাসনায় লিঙ্গমূর্তি সর্বোত্তম। কারণ লিঙ্গমূর্তি অনন্তের প্রতীক, লয়ের প্রতীক। জগতের জড়চেতনা সম্পন্ন সকল কিছুই লয় হয় শিবে। তাই একাধারে যেমন সৃষ্টি সুন্দরের দেবতা, অপরপিঠে আবার লয়, বিনাশ এবং ধ্বংসের দেবতা। ধ্বংসের গর্ভেই নিহিত থাকে সৃষ্টির বীজ। যে বীজেই জগত প্রকাশিত।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়